বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৪ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ছাত্রলীগ নেতারা কেন হারিয়ে যান

ছাত্রলীগ নেতারা কেন হারিয়ে যান

স্বদেশ ডেস্ক:

ছাত্ররাজনীতিতে হাতেখড়ি, এর পর রাজনীতির মূল ময়দানে নাম লিখিয়েছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন- এমন অসংখ্য রাজনীতিবিদ রয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ১৯৯০-এর আগের ও পরের সময়ের বিচারে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ছাত্র নেতৃত্বে যে ত্যাগ-তিতিক্ষা-সংগ্রাম ছিল ক্রমেই তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এর পরিবর্তে স্থান করে নিচ্ছে ভোগ-বিলাস-বৈষয়িকতা। সঙ্গত কারণেই নব্বই পূর্ব সময়ের ছাত্রলীগ নেতারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে যতটা উজ্জ্বল; নব্বই-উত্তর ছাত্রলীগ নেতারা ততোটাই অনুজ্জ্বল।

হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া নব্বই পরবর্তী সময়কার ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তেমন একটা স্থান করে নিতে পারেননি। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পেরিয়ে আসার পর ভ্রাতৃপ্রতীম এ সংগঠনটির নেতাদের অধিকাংশই মূল দলে কিংবা আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংগঠনে ঠাঁই পাননি; হয়ে গেছেন আপাত গুরুত্বহীন। বিভিন্ন উৎসব-উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে গিয়ে স্মারক-ছবি তোলা আর সরকারের দপ্তরে-দপ্তরে তদবির করা ছাড়া তাদের কর্মকা- আর কোথাও দৃশ্যমান নয়। যদিও ছাত্রলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পরবর্তী সময়ে রাতারাতি গাড়ি-বাড়ির মালিক বনে গেছেন অধিকাংশ নেতা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর দেশের ছাত্ররাজনীতিতে শুধু নয়, জাতীয় রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে, নেতিবাচক। বিশ্লেষকরা বলছেন, বায়ান্ন থেকে শুরু করে ঊনসত্তর, একাত্তর হয়ে নব্বই-পূর্ব আন্দোলন সংগ্রাম মোকাবিলায় ছাত্রনেতাদের যে সর্বজন গৃহীত নেতৃত্ব ছিল, নব্বই উত্তর সময়ে তা উধাও হয়ে গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোপুরি সুবিধা ভোগ করেছে নব্বই পরবর্তী ছাত্রলীগের একটি বড় অংশ। সরকারি দলের ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্ররাজনীতির বদলে সরকারি অফিসে তদবির বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ব্যাবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের অনেক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন বড় ভাইয়ের পেশিশক্তি হিসেবে ‘টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে সম্পৃক্ত হয়ে নেতৃত্বগুণও হারিয়েছেন ইতোমধ্যে। এসব নানাবিধ কারণে আওয়ামী লীগের মূল দলে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই উপেক্ষিত। তদুপরি, দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আমলা-ব্যবসায়ীদের প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়াও ছাত্রনেতাদের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ময়দানকে সংকুচিত করে ফেলে যা শুরু হয় জিয়াউর রহমানের আমলে এবং এরশাদের আমলে খুবই গতি পায়।

অবশ্য নেতিবাচকের পাশাপাশি কয়েকটি ইতিবাচক উদাহরণও রয়েছে নব্বই পরবর্তী ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। ব্যক্তি ইমেজ এবং ছাত্ররাজনীতির ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের অনেকেই আজ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ছাত্রলীগের রাজনীতির পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক হন তিনি। এর পর টানা তিনবার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে খালিদকে দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এবং পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কেএম এনামুল হক শামীম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতৃত্ব থেকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে আসেন। দুজনই বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আল মাহমুদ স্বপন টানা দুইবারের এমপি ও তিনবারের সাংগঠনিক সম্পাদক। এনামুল হক শামীম আওয়ামী লীগের এবার সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার আগে ছিলেন কার্যনির্বাহী সদস্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি শামীম একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথম নির্বাচিত হন এবং উপমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। এ কমিটিরই আরেক নেতা সুজিত রায় নন্দী আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক।

নব্বই পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের ইতিহাসের সবচেয়ে অল্প সময়ের জন্য দায়িত্বে ছিল মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী ও ইকবালুর রহিম কমিটি। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত। এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবালুর রহিম জাতীয় সংসদের টানা দুবারের হুইপ এবং দিনাজপুর সদর আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। এ কমিটির অপর দুই ছাত্রনেতা ইকবাল হোসেন অপু এবং আনোয়ার হোসেনকে সর্বশেষ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ইকবাল হোসেন অপু শরীয়তপুরের একটি আসন থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।

১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ছাত্রলীগে ছিল বাহাদুর বেপারি ও অজয় কর খোকনের নেতৃত্বাধীন কমিটি। দুজনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসতে এবং নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এর পর দায়িত্ব পান লিয়াকত শিকদার ও নজরুল ইসলাম বাবু। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার মতে, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি ঘোষণার আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত ছিলেন লিয়াকত শিকদার। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন কোথাও নেই তিনি। ফরিদপুরের একটি আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে টানা তিনবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। লিয়াকত-বাবু কমিটির আরেক নেতা দেলোয়ার হোসেন এখন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। তিনি ওই কমিটির সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। লিয়াকত-বাবু কমিটির আরও দুজন নেতা; মারুফা আক্তার পপি এবং সাইফুজ্জামান শিখর। পপি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এবং শিখর মাগুরা সদর আসনের সংসদ সদস্য।

২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা মাহমুদ হাসান রিপন এবং মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে দলীয় মনোনয়ন লাভের চেষ্টা করছেন। নিজ জেলাতে আওয়ামী লীগের সদস্য পদে রয়েছেন এ দুজন। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সিদ্দিকী নাজমুল আলম। সোহাগ চেষ্টা করছেন বাগেরহাটের একটি আসনে দলীয় মনোনয়ন লাভের। আর নাজমুল দেশের বাইরে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত, মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। এদের পর ছাত্রলীগের দায়িত্বে ছিলেন সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসাইন। সদ্য সাবেক এ দুই নেতা ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের আলোচিত সিন্ডিকেটের শেষ উত্তরাধিকারী। এ সিন্ডিকেট কর্তৃক দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রিত হতো ছাত্রলীগের নেতৃত্ব। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক যাচাই-বাছাই করে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেন। কিন্তু মাত্র পনেরো মাসের মধ্যেই তাদের নামে বিস্তর অভিযোগ জমা হয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর। এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি উদার না হলে দুয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্রলীগে শোভন-রাব্বানি যুগল নেতৃত্বের ইতি ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নব্বইয়ের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছাত্রলীগের নেতাদের উপস্থিতির হার কমের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ছাত্রলীগের সবাই তো আর মূল দলে রাজনীতি করবে না। সবাই চাইলেও তো আসতে পারবে না। যারা সবদিক থেকে যোগ্যতম তারাই আসে মূল দলের রাজনীতিতে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, ছাত্রলীগে যারা ছিল তারা এখন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ করবে; ধাপে ধাপে আসবে আওয়ামী লীগে। তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই।

ছাত্ররাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা, ব্যক্তিত্বের সর্বজনীন ছটা নষ্ট হয়ে গেছে ’৯০-এর পর। নব্বই-উত্তর সময়ে হাতেগোনা কিছু নেতা স্বকীয় গুণে জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্বে আসতে পেরেছেন। সামনে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলন উত্তর কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছাত্রলীগের সেসব সাবেক নেতাই স্থান পাবেন, যিনি নিজ কর্মগুণে উজ্জ্বল।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকালে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের অন্যতম নেতা শফী আহমেদ মনে করেন সময়ভেদে এ দেশের ছাত্ররাজনীতির তিনটি পর্বÑ একাত্তর-পূর্ব; নব্বই-পূর্ব ও নব্বই-উত্তর। একাত্তর-পূর্ব ছাত্ররাজনীতিতে গতিশীলতা এনেছিল দেশের স্বাধীনতা কামনা।

নব্বই-পূর্ব সময় ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারের পতন ঘটানো। এ দুটো সময়েই ছাত্ররাজনীতি ছিল এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট প্রকৃতির। এরপর নব্বই-উত্তর ছাত্ররাজনীতিতে যাত্রা শুরু হয় প্রো-এস্টাব্লিশমেন্ট ধারার। এ মৌলিকতার পরিবর্তনে সংগ্রাম-ত্যাগ-তিতিক্ষার পরিবর্তে ভোগ-বিলাস-বৈষয়িকতায় বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন ছাত্রনেতারা। সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে ছাত্ররাজনীতি এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে।

শফী আহমেদের বিশ্লেষণেই প্রতিচ্ছায়া পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদারের ব্যাখ্যায়। তিনি বলেন, নব্বইয়ের পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনে যারাই ছিলেন, তাদের মধ্যে ছাত্ররাজনীতির বদলে অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো বেশি লক্ষ্য করা গেছে। সন্ত্রাস এর আগেও ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের পর ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের শীর্ষনেতাদের মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়।

এর পর তিনি ছাত্রলীগের সর্বশেষ যে বিষয় নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে, তার ওপর মন্তব্য করেন। বলেন, পত্রপত্রিকা মারফত জেনেছি, ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এটা ভালো উদ্যোগ। এমন শাসন সবসময়ই প্রয়োজন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877